এভারকেয়ার হসপিটাল ঢাকায় আপনাকে স্বাগতম
তরুণদের ডায়াবেটিস: এক বাড়তে থাকা উদ্বেগ


ডা. আহসানুল হক আমিন
লেখক
প্রথাগতভাবে ডায়াবেটিসকে মূলত প্রাপ্তবয়স্কদের রোগ হিসেবে দেখা হতো, কিন্তু এখন এটি দ্রুতই শিশু, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে। বিশ্বজুড়ে তরুণ বয়সে টাইপ–১ ও টাইপ–২ ডায়াবেটিস–এর সংখ্যা বাড়ছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। কারণ, সতর্কতা ও সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া এই রোগ দীর্ঘমেয়াদে শরীরের নানা জটিলতার কারণ হয়ে দাড়ায়।
তরুণদের মধ্যে ডায়াবেটিসের ধরন
টাইপ–১ ডায়াবেটিস
এক্ষেত্রে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ত্রুটির ফলে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলি আক্রান্ত হয়। ফলে শরীরে ইনসুলিনের ঘাটতি হয় এবং আজীবন ইনসুলিনের মাধ্যমে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
টাইপ–১ ডায়াবেটিস হঠাৎ করেই দেখা দিতে পারে এবং এটি জীবনধারা বা খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সাধারণত শিশু বা কৈশোর বয়সে এর সূচনা হয়।
টাইপ–২ ডায়াবেটিস
একসময় এটি শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের রোগ হিসেবে বিবেচিত হতো, কিন্তু এখন কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও এর প্রকোপ বাড়ছে। এর কারণ হলো অল্প শারীরিক পরিশ্রম, অতিরিক্ত ওজন, নিদ্রার স্বল্পতা এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। এই অবস্থায় শরীর ইনসুলিন তৈরি করতে পারলেও সেটি কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয় না।
যে লক্ষণগুলোতে সতর্ক হবেন
প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়াবেটিস সনাক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু বা কিশোরের মধ্যে নিচের উপসর্গগুলো দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
- অস্বাভাবিক পিপাসা ও বারবার প্রস্রাব
- খাবার খাওয়ার পরও ওজন কমে যাওয়া
- অতিরিক্ত ক্লান্তি বা রাগ-ঝাঁজ
- দৃষ্টিতে ঝাপসা দেখা
- ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া বা বারবার ইনফেকশন
- পূর্বে শুকনো থাকা শিশুর হঠাৎ বিছানায় প্রস্রাব করা
এই উপসর্গগুলো প্রায়ই সাধারণ অসুস্থতা ভেবে এড়িয়ে যাওয়া হয়, ফলে রোগ শনাক্তে দেরি হয়। বিশেষ করে টাইপ–১ ডায়াবেটিসে ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস (DKA) নামক বিপজ্জনক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
তরুণদের মধ্যে ডায়াবেটিসের কারণ
কারণগুলো টাইপ–১ ও টাইপ–২–এর ক্ষেত্রে আলাদা, তবে কিছু সাধারণ প্রভাবক হলো:
- জিনগত প্রবণতা: পরিবারের কারও ডায়াবেটিস থাকলে ঝুঁকি বাড়ে।
- অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া: ভাইরাস সংক্রমণ বা পরিবেশগত কারণেও টাইপ–১ ডায়াবেটিসের সূচনা হতে পারে।
- জীবনধারাগত কারণ: অল্প শারীরিক কার্যক্রম, অতিরিক্ত ওজন, অস্বাস্থ্যকর খাবার ও নিদ্রাহিনতা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
ডায়াবেটিস নিয়ে জীবনযাপন
তরুণ বয়সে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে তা মানসিকভাবে কষ্টকর হতে পারে, তবে সঠিক যত্ন ও শিক্ষা পেলে তারা একদম স্বাভাবিক ও সক্রিয় জীবনযাপন করতে পারে।
যত্নের মূল দিকগুলো হলো:
- নিয়মিত ব্যায়াম ও খেলাধুলা
- সুষম খাদ্যাভ্যাস: শাকসবজি, ফল, পূর্ণ শস্য ও কম চিনি–যুক্ত খাবার গ্রহণ। এক্ষেত্রে পুষ্টিবিদের উপদেশ অত্যন্ত কার্যকর
- নিয়মিত রক্তে শর্করা পর্যবেক্ষণ
- চিকিৎসকের পরামর্শমতো ইনসুলিন বা ওষুধ গ্রহণ
- শিশু, অভিভাবক এবং পরিবার সকলেরই সচেতনতার প্রয়োজন আছে
টাইপ–২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ সম্ভব
টাইপ–১ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা না গেলেও টাইপ–২ ডায়াবেটিস প্রায়ই প্রতিরোধযোগ্য।
এর জন্য প্রয়োজন সহজ কিন্তু কার্যকর কিছু পদক্ষেপ:
- প্রতিদিন নিয়মিত শরীরচর্চা ও বাইরে খেলা
- মিষ্টি, তৈলাক্ত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা
- স্ক্রিন টাইম সীমিত ও পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা
- যাদের পারিবারিক ঝুঁকি আছে, তাদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা
তরুণদের ডায়াবেটিস বাড়ছে—এটি এক কঠিন বাস্তবতা, কিন্তু এটি জীবনকে থামিয়ে দিতে পারে না। সচেতনতা, প্রাথমিক সনাক্তকরণ ও চিকিৎসার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মও পূর্ণাঙ্গ, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারে।
পরিবার, শিক্ষক ও চিকিৎসক—সবার মিলিত প্রচেষ্টাই পারে আগামী প্রজন্মকে ডায়াবেটিসের জটিলতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে।
লেখক:
সিনিয়র কনসালটেন্ট
ডায়াবেটলজি এন্ড এন্ডোক্রাইনোলজি ডিপার্টমেন্ট
এভারকেয়ার হসপিটাল ঢাকা
